তারেক শামসুর রেহমান
মিয়ানমারে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা পুনরায় জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানের শিকার হয়েছেন। দলে দলে ইসলাম ধর্মাবলম্বী, যারা রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিত, তাদের পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ সঙ্গত কারণেই এসব রোহিঙ্গাকে গ্রহণ করতে পারে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে এ ব্যাপারে একটি বিবৃতিও দিয়েছেন। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের ভূমিকা একটা প্রশ্নের মাঝে থেকে যাবেই। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন যখন মিয়ানমারের দরজা পশ্চিমাদের জন্য খুলে দিয়েছেন, যখন বিরোধী নেতা অং সান সু চি বিদেশ ভ্রমণে রয়েছেন, তখন নতুন করে এই জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান শুরু হলো কেন? পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ অভিযানের বিষয়টি কীভাবে দেখছে, সেটাই আমাদের বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।
বলা প্রয়োজন, নতুন করে রোহিঙ্গা উচ্ছেদ অভিযান আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপক স্থান পেয়েছে। যারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করে, সে রকম একটি প্রতিষ্ঠান, নিউইয়র্কের ঙঢ়বহ ঝড়পরবঃু ঋড়ঁহফধঃরড়হ-এর গত ১৪ জুনের এক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ অভিযানের বিষয়টি স্থান পেয়েছে। এমনকি অং সান সু চি যখন জেনেভায় (১৪ জুন), তখন তাকেও সাংবাদিকরা এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন। বাংলাদেশের মিডিয়ায় সু চির ওই বক্তব্য ছাপা না হলেও বিদেশি মিডিয়ায় তা ছাপা হয়েছে এবং আশ্চর্যজনকভাবে সু চি অনেকটা সরকারের পক্ষেই অবস্থান নিলেন। যেখানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের, যাদের মধ্যে ৩ মাসের শিশু পর্যন্ত রয়েছে, তাদের যখন নিজস্ব বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা হয়, তখন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি একটিবারের জন্যও এর নিন্দা করলেন না। আমাদের শোনালেন সেই পুরনো 'কাহিনী', বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন। বিদেশি মিডিয়ায় তার বক্তব্য ছাপা হয়েছে এভাবে_ 'ডব যধাব ঃড় নব াবৎু পষবধৎ ধনড়ঁঃ যিধঃ ঃযব ষধংি ড়ভ পরঃরুবহংযরঢ় ধৎব ধহফ যিড় ধৎব বহঃরঃষবফ ঃড় ঃযবস.' অর্থাৎ পরোক্ষভাবে বলার চেষ্টা করলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নন! সরাসরি তিনি এ কথাটা বলেননি বটে, কিন্তু তার বক্তব্যে পরোক্ষভাবে এ কথাটিই ফুটে উঠেছে। তিনি সহিংস ঘটনাবলির নিন্দাও করেননি।
এখানেই এসে যায় মূল বক্তব্যটি_ মিয়ানমারের নেতৃত্ব সেখানে এক ধরনের 'বৌদ্ধরাজ' প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। এ প্রক্রিয়া তারা যে আজকেই শুরু করেছে, তা নয়। এই মানসিকতা তাদের দীর্ঘদিনের; মিয়ানমার শুধু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের রাষ্ট্রই হবে, সেখানে অন্য ধর্মাবলম্বীদের কোনো স্থান হবে না। মিয়ানমারে শুধু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাই বসবাস করে না। সেখানে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি কারেন, কাচিন কিংবা শান জাতিও যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে, যাদের মধ্যে খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বীও রয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারের নেতৃত্ব এই দেশটিকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করতে চায়। অথচ পরিসংখ্যান বলে, ৬৪ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর এই দেশটিতে প্রায় ১৩৫টি ছোট-বড় নৃগোষ্ঠী রয়েছে। বড় এবং প্রভাবশালী নৃগোষ্ঠীগুলো তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় ও জাতিরাষ্ট্রের দাবিতে সেখানে দীর্ঘদিন ধরে একটি সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করে আসছে। কারেন কিংবা শান জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগ্রামের খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হলেও রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা কোনো সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করছে তেমনটি শোনা যায় না।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ২০১০ সালের এক প্রতিবেদনে 'হারকাত উল জিহাদ-ই-ইসলামী' নামক একটি বাংলাদেশি মৌলবাদী সংগঠনের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল, যারা রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। বাংলাদেশ ওই সংগঠনটিকে ২০০৫ সালে নিষিদ্ধ করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য সংসদে জামায়াতে ইসলামীর কথা উল্লেখ করেছেন, যারা রোহিঙ্গাদের উস্কানি দিচ্ছে বলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে। এ ব্যাপারে আরও তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। একটি বন্ধু রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক সংগঠন সশস্ত্র উস্কানি দেবে, তা কাম্য হতে পারে না।
ইতিহাস বলে, রোহিঙ্গারা মূলত আরব বংশোদ্ভূত। এক সময় আরব বণিকরা এ অঞ্চলে এসে বসবাস করতে শুরু করে। তাদের কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করা যাবে না। প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে। ১৯৭৮ সালে ব্যাপক হারে উচ্ছেদ অভিযানের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে আসতে ও বসবাস করতে বাধ্য হয়। পরে ১৯৯১ সালেও দ্বিতীয় দফায় আরও বেশ কিছু রোহিঙ্গা কক্সবাজার এলাকায় এসে আশ্রয় নেয়। সরকারিভাবে ২৮ হাজার রোহিঙ্গা রেজিস্ট্রিভুক্ত করা হলেও ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় দু'লাখ অবৈধ রোহিঙ্গা বর্তমানে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস করছে। প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন সরকারের মতো অং সান সু চি ও তার দল এনএলডিও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। এনএলডি রোহিঙ্গাদের অভিহিত করেছে 'বাঙালি টেররিস্ট' হিসেবে।
আজকে মিয়ানমারের জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান নব্বইয়ের দশকে বসনিয়া-হারজেগোভিনার জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানের কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৯২ সালের মার্চে বসনিয়ার জনগোষ্ঠী স্বাধীনতার পক্ষে গণভোটে রায় দিলে সেখানে সার্বিয়ার উস্কানিতে জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান চলে। শতকরা ৪৩ ভাগ মুসলমান জনগোষ্ঠী হত্যা, ধর্ষণ ও উচ্ছেদ অভিযানের শিকার হয়। এই দেশটিকে সার্বিয়া একটি আশ্রিত রাজ্য বানাতে চেয়েছিল। জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান বন্ধে ১৯৯৪ সালের মার্চে ন্যাটোর বিমানবহরকে সার্বীয় অবস্থানের ওপর বিমান হামলা পর্যন্ত চালাতে হয়েছিল। আজ এত বছর পর সেই সার্বীয় গণহত্যাকারীদের হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হচ্ছে। বৃহৎ পরিসরে দেখলে বসনিয়ার সেই পরিস্থিতির সঙ্গে আজকের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতির কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে মুসলমানরা উচ্ছেদ অভিযানের শিকার হচ্ছে এবং রাখাইন রাজ্যটি ধীরে ধীরে একটি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে পরিণত হতে যাচ্ছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের কোনো নাগরিকত্ব দেওয়া হয়নি। এমনকি সব ধরনের সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত। এখানে আরও একটি বৈসাদৃশ্য আমাদের চোখে পড়ার কথা। যেখানে বসনিয়ায় ন্যাটোকে এক পর্যায়ে বিমান হামলা চালাতে হয়েছিল, সেখানে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ অভিযানের ব্যাপারে পশ্চিমা বিশ্ব নীরব। বরং উল্টো বাংলাদেশকে সীমান্ত খুলে দেওয়ার 'চাপ' পর্যন্ত দিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছে। বাংলাদেশ এমনিতেই জনসংখ্যার ভারে আক্রান্ত। বাংলাদেশ আর অতিরিক্ত রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণ করতে পারে না। বাংলাদেশ ১৯৫১ সালের জাতিসংঘ শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। সুতরাং বাংলাদেশ রোহিঙ্গা গ্রহণ করতে বাধ্য নয়। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কমিশন প্রয়োজনে রোহিঙ্গাদের বিশ্বের অন্যত্র, এমনকি ইউরোপে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারে। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের নিয়ে ইতিমধ্যে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। রোহিঙ্গারা নানা রকম অনৈতিক ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। তারা ইতিমধ্যে কক্সবাজার এলাকার ব্যাপক বনাঞ্চল ধ্বংস করেছে।
আমরা নতুন করে আরেকটি 'সমস্যা' দেখতে চাই না, যেখানে বিদেশি দাতা সংস্থা, এমনকি জাতিসংঘ পর্যন্ত আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় নাক গলানোর সুযোগ পাক। এখানেই এসে যায় রিয়েল পলিটিক্সের প্রশ্নটি। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাখ্যান করেছে বটে। কিন্তু কেন প্রত্যাখ্যান করল, তা বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছে তুলে ধরতে হবে। জাতিসংঘে বিষয়টি প্রয়োজনে তুলতে হবে জোরালোভাবে। কিছু মুসলিম দেশ রয়েছে, যারা রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। তাদের বোঝাতে হবে, এখানে 'মানবতা' কোনো বিষয় নয়, বিষয় 'রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা'। সেই সঙ্গে দ্রুত মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে 'সংলাপ' শুরু করা উচিত। আমাদের স্বার্থেই মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করা প্রয়োজন। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তা বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়ে নয়।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
www.tsrahmanbd.blogspot.com