তা রে ক শা ম সু র রে হ মা ন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরের পদত্যাগের এক মাসের মাথায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক এম আবদুস সোবহানের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে দৈনিক যুগান্তরে গত ১৫ জুন। অধ্যাপক কবির জাহাঙ্গীরনগরে প্রায় ২০০ শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল নিয়োগ বাণিজ্যের, যদিও বিষয়টি কখনই প্রমাণিত হয়নি। এবং বর্তমান জাবি প্রশাসনও এই তথাকথিত নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগটি তদন্ত করে দেখার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তারা আদৌ তদন্ত করে দেখবে, এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ না উঠলেও সাবেক উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে সেখানে পরিবর্তন এসেছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে হেরে গেছেন সাবেক উপ-উপাচার্য, যে কারণে তাকে পদত্যাগ করতে হয়। তবে সাবেক উপ-উপাচার্য অনেক অভিযোগ মাথায় নিয়েই পদত্যাগ করেন। শিক্ষক নিয়োগে, বিশেষ করে প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক নিয়োগে তিনি ব্যক্তিগত পছন্দ, দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন বেশি। যে কারণে অনেক যোগ্য প্রার্থী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাননি। এমনকি তার নিজের ছেলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে চাইলে তিনি উপাচার্যের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যান। এ ক্ষেত্রে তার ছেলের চেয়ে আরও অনেক যোগ্য প্রার্থী ছিল, যারা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তবে তিনি তার ছেলেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিতে পেরেছিলেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগটি এনেছে সরকারি দলের নেতা ও কর্মীরা। সেখানে ভিসি ১৭৪ জন সাধারণ কর্মচারীকে নিয়োগ দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে দলীয় কর্মীরা নিয়োগ না পাওয়ায় তারা তিন দিন পরিবহন বন্ধ করে দেয়। অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন ছাড়াই ভিসি ওইসব কর্মচারীকে নিয়োগ দেন। এর আগে সেখানে দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগেরও অভিযোগ উঠেছিল। ভিসিরা নিয়োগ পান কি দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগের জন্য? এটাই কি ভিসিদের একমাত্র কাজ? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি দায়িত্ব গ্রহণ করে তিন বছরে ২০০ শিক্ষক ও কয়েকশ’ কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন, যাদের অনেকের বাড়ি গোপালগঞ্জ। যাদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগে দেওয়া হয়েছে, অভিযোগ আছে তারা পাঠদানে ব্যর্থ। এটা সর্বকালের রেকর্ড। অতিরিক্ত ও অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগে কি শিক্ষার মান বাড়ে? এক বিষয়ের ছাত্রকে তিনি অন্য বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। দল ভারি করার জন্য একের পর এক অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন, যাদের পড়ানোর মতো কোনো কোর্স নেই। কোনো কোনো বিভাগ চলছে শুধু প্রভাষকদের দিয়ে। শিক্ষার মানোন্নয়ন তাতে হল কতটুকু? লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে যায় যখন শুনি টাকার বিনিময়ে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ হয়েছে। এটা এখন প্রমাণ করবে কে? ৪০ লাখ টাকা নিয়ে ধরা পড়ল জাবির এক কর্মচারী। নাম তার জসিমুদ্দিন। আশুলিয়া থানায় মামলা হল। এ তো আরেক ‘কালো বিড়াল’-এর কাহিনী! যুগান্তরের ৪ মের ওই সংবাদের কোনো প্রতিবাদ করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো কর্মকর্তা, শিক্ষক জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থেই এর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সাবেক ভিসির বিরুদ্ধে অভিযোগ-তিনি ‘ছাত্র সাংবাদিকদের’ মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য একটি ‘প্রেসক্লাব’ গঠন করেছেন। এর কি আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল? ছাত্ররা সাংবাদিকতা করে। ওদেরকে ওদের মতো থাকতে দেওয়াই মঙ্গল। গত ৪০ বছরে যা হয়নি, তা তার জমানায় হয়েছে। একজন সাংবাদিককে তিনি ‘শিক্ষক’ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন কলা অনুষদের একটি বিভাগে। অভিযোগ উঠেছে ‘ছাত্র সাংবাদিকদের’ সাইজ করার জন্যই মূলত এই কাজটি তিনি করেছেন। এভাবে কি সাংবাদিকদের ‘নিয়ন্ত্রণে’ রাখা যায়?
ভিসিরা কেন এমন হয়? শরীফ এনামুল কবিরের বাড়ি গোপালগঞ্জ। তাই বলে কি শুধু গোপালগঞ্জের মানুষদের চাকরি দিতে হবে? গ্রেটার ফরিদপুর হলেই কি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে, কিংবা প্রমোশন? শুধু গোপালগঞ্জ আর ফরিদপুর নিয়েই কি বাংলাদেশ? আমার এক ছাত্র, তার অনার্স ও মাস্টার্স দুটোতেই প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। শিক্ষক হিসেবে তার চাকরি হয়নি। কেননা সে দলবাজ ছিল না। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্টকে আমরা শিক্ষক হিসেবে নেইনি, নিয়েছি ফার্স্ব ক্লাস সপ্তমকে। এর পেছনে যে ‘কাহিনী’, সেই ‘কাহিনী’ এ জাতির জানা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ‘কালো বিড়াল’, সেই ‘কালো বিড়াল’ খুঁজে বের করা প্রয়োজন। একটি বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের জন্য এসব ‘কাহিনী’ কি যথেষ্ট নয়? ইতিহাসে শরীফ এনামুল কবিরের নাম থেকে যাবে বটে, কিন্তু সেই ‘নামকে’ উজ্জ্বল করবে না।
আমি যখন মঞ্জুরি কমিশনে ছিলাম, তখন তদন্ত করে দেখেছিলাম অনেক ভিসি অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ করেন। ব্যক্তিগত কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ব্যবহার করেন। আমি মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট জমা দিয়েছিলাম। এখন শুনছি জাবির সাবেক ভিসি একাধিক গাড়ি ব্যবহার করতেন। তার মেয়ে ঢাকায় পড়তে যেত সরকারি জ্বালানি খরচ করে। এটা যদি সত্য হয়ে থাকে, তা হলে তা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য। আরেকজন উপ-উপাচার্য গত চার বছর নিয়মিত ঢাকা থেকে গিয়ে সরকারি জ্বালানি (গ্যাস নয়, অকটেন) খরচ করে অফিস করেছেন। তিনি এটি পারেন না। মঞ্জুরি কমিশনের উচিত ‘সরকারি অর্থের অপচয়ের’ অভিযোগটি তদন্ত করে দেখা। একজন উপাচার্য, উপ-উপাচার্য আর্থিক কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হবেন না এমনটাই দেখতে চাই।
ভিসিরা কেন এমন হয়? ভিসি হলেই নিজ এলাকার লোকদের চাকরি দিতে হবে? রংপুরের কিংবা বরিশালের ভিসির কাহিনী ভয়াবহ। রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তার আপনজন থেকে শুরু করে তার গ্রামের বাড়ির প্রায় অর্ধশত লোককে ‘চাকরি’ দিয়েছেন। ছেলে, ছেলের বউ, ভাই-কে নেই লিস্টে। এরা কেমন উপাচার্য? জাবির ভিসি তার নিজের মেয়েকে শিক্ষক বানাননি বটে; কিন্তু তার সঙ্গে যারা ‘দল’ করেছেন তাদের সবার সন্তানদের, তাদের বউ অথবা স্বামীদের ‘চাকরি’ হয়েছে জাহাঙ্গীরনগরে। তারা এত ‘মেধাবী’ যে তাদের অন্য ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোথাও চাকরি হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় কি চাকরির একটি ক্ষেত্র? এখানে নিজের আত্মীয়স্বজন, কিংবা দলীয় লোকদের অথবা নিজ এলাকার লোকদের চাকরি দিতে হবে? এমন ভিসি আমরা কবে পাব, যিনি দলবাজ হবেন না, যোগ্য ছাত্রদেরই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেবেন! শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা তাই প্রয়োজন। শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে ‘সাফল্য’ বিবেচনায় নিলে চলবে না। তার উপস্থাপনের যোগ্যতা ও লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষা নেয়াও জরুরি। আর এ কাজটি করবে মঞ্জুরি কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় নয়। উপাচার্যের হাতে শিক্ষক নিয়োগের কোনো ক্ষমতা থাকবে না। আর এর চেয়েও বড় কথা একজন ছাত্রের পাস করার পর গবেষণা সহকারী হিসেবে একজন সিনিয়র শিক্ষকের অধীনে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। পৃথিবীর প্রতিটি উন্নত দেশে এমনটি আছে। তার পরই তাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে, এর আগে নয়। অধ্যাপক আজাদ চৌধুরী মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান। তিনি তো পারেন সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের জন্য নতুন একটি আইন করতে। এটি নিয়ন্ত্রণ করবে মঞ্জুরি কমিশন। উপাচার্যের হাতে ক্ষমতা থাকলে দলবাজ শিক্ষকদের সন্তানরা শিক্ষক হবে, আর মেধাবীরা হারিয়ে যাবে। জাবির শিক্ষকদের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে বিগত তিন বছরের সকল অনিয়মের শ্বেতপত্র প্রকাশ করার। ক্ষতি কী? বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থেই এটি করা উচিত। আর এভাবে অনির্বাচিত উপাচার্য নয়, আমরা চাই নির্বাচিত একজন উপাচার্য, যার দায়বদ্ধতা থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবারের কাছে। জাবিতে অনেক ‘ক্ষত’ সৃষ্টি হয়েছে। সাবেক ভিসি এই ‘ক্ষত’গুলো সারিয়ে তোলার কোনো উদ্যোগ নেননি। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক ঘটনা ঘটেছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে সিনিয়র শিক্ষকরা অপমানিত হয়েছেন। অত্যন্ত সুকৌশলে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব ‘তৈরি’ করা হয়েছে, যা কাঙ্ক্ষিত নয়।
ভিসিদের কাহিনী যেভাবে প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে, তাতে করে কোনো শুভবুদ্ধির মানুষ আগামীতে আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হবেন না। দেশে ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ৩৫ জন শিক্ষককে আমরা ভিসি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছি। আর যারা ভিসি হচ্ছেন, তাদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এই একুশ শতকে এসেও খোদ রাজধানীতে ভিসি হয়েছেন এমন অনেক শিক্ষক, যাদের অনার্স ডিগ্রি নেই, একজনের আবার পিএইচডি ডিগ্রিও ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক আনুগত্য ছিল প্রবল। তাই ভিসি হয়েছেন। সম্ভবত সময় এসেছে এটা বিবেচনায় নেওয়ার যে, একটা সার্চ কমিটির মাধ্যমে ভিসি নিয়োগ এখন সময়ের দাবি। দলীয় বিবেচনায় ভিসি নিয়োগ হলে তারা দলীয় লোকদেরই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেবেন। এটাই স্বাভাবিক। এতে করে আমরা উচ্চশিক্ষাকে ধ্বংস করে ফেলছি। আর আমরা পরিণত হচ্ছি মেধাশূন্য একটি জাতিতে।
লেখক : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
www.tsrahmanbd.blogspot.com
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরের পদত্যাগের এক মাসের মাথায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক এম আবদুস সোবহানের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে দৈনিক যুগান্তরে গত ১৫ জুন। অধ্যাপক কবির জাহাঙ্গীরনগরে প্রায় ২০০ শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল নিয়োগ বাণিজ্যের, যদিও বিষয়টি কখনই প্রমাণিত হয়নি। এবং বর্তমান জাবি প্রশাসনও এই তথাকথিত নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগটি তদন্ত করে দেখার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তারা আদৌ তদন্ত করে দেখবে, এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ না উঠলেও সাবেক উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে সেখানে পরিবর্তন এসেছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে হেরে গেছেন সাবেক উপ-উপাচার্য, যে কারণে তাকে পদত্যাগ করতে হয়। তবে সাবেক উপ-উপাচার্য অনেক অভিযোগ মাথায় নিয়েই পদত্যাগ করেন। শিক্ষক নিয়োগে, বিশেষ করে প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক নিয়োগে তিনি ব্যক্তিগত পছন্দ, দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন বেশি। যে কারণে অনেক যোগ্য প্রার্থী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাননি। এমনকি তার নিজের ছেলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে চাইলে তিনি উপাচার্যের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যান। এ ক্ষেত্রে তার ছেলের চেয়ে আরও অনেক যোগ্য প্রার্থী ছিল, যারা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তবে তিনি তার ছেলেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিতে পেরেছিলেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগটি এনেছে সরকারি দলের নেতা ও কর্মীরা। সেখানে ভিসি ১৭৪ জন সাধারণ কর্মচারীকে নিয়োগ দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে দলীয় কর্মীরা নিয়োগ না পাওয়ায় তারা তিন দিন পরিবহন বন্ধ করে দেয়। অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন ছাড়াই ভিসি ওইসব কর্মচারীকে নিয়োগ দেন। এর আগে সেখানে দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগেরও অভিযোগ উঠেছিল। ভিসিরা নিয়োগ পান কি দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগের জন্য? এটাই কি ভিসিদের একমাত্র কাজ? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি দায়িত্ব গ্রহণ করে তিন বছরে ২০০ শিক্ষক ও কয়েকশ’ কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন, যাদের অনেকের বাড়ি গোপালগঞ্জ। যাদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগে দেওয়া হয়েছে, অভিযোগ আছে তারা পাঠদানে ব্যর্থ। এটা সর্বকালের রেকর্ড। অতিরিক্ত ও অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগে কি শিক্ষার মান বাড়ে? এক বিষয়ের ছাত্রকে তিনি অন্য বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। দল ভারি করার জন্য একের পর এক অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন, যাদের পড়ানোর মতো কোনো কোর্স নেই। কোনো কোনো বিভাগ চলছে শুধু প্রভাষকদের দিয়ে। শিক্ষার মানোন্নয়ন তাতে হল কতটুকু? লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে যায় যখন শুনি টাকার বিনিময়ে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ হয়েছে। এটা এখন প্রমাণ করবে কে? ৪০ লাখ টাকা নিয়ে ধরা পড়ল জাবির এক কর্মচারী। নাম তার জসিমুদ্দিন। আশুলিয়া থানায় মামলা হল। এ তো আরেক ‘কালো বিড়াল’-এর কাহিনী! যুগান্তরের ৪ মের ওই সংবাদের কোনো প্রতিবাদ করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো কর্মকর্তা, শিক্ষক জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থেই এর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সাবেক ভিসির বিরুদ্ধে অভিযোগ-তিনি ‘ছাত্র সাংবাদিকদের’ মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য একটি ‘প্রেসক্লাব’ গঠন করেছেন। এর কি আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল? ছাত্ররা সাংবাদিকতা করে। ওদেরকে ওদের মতো থাকতে দেওয়াই মঙ্গল। গত ৪০ বছরে যা হয়নি, তা তার জমানায় হয়েছে। একজন সাংবাদিককে তিনি ‘শিক্ষক’ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন কলা অনুষদের একটি বিভাগে। অভিযোগ উঠেছে ‘ছাত্র সাংবাদিকদের’ সাইজ করার জন্যই মূলত এই কাজটি তিনি করেছেন। এভাবে কি সাংবাদিকদের ‘নিয়ন্ত্রণে’ রাখা যায়?
ভিসিরা কেন এমন হয়? শরীফ এনামুল কবিরের বাড়ি গোপালগঞ্জ। তাই বলে কি শুধু গোপালগঞ্জের মানুষদের চাকরি দিতে হবে? গ্রেটার ফরিদপুর হলেই কি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে, কিংবা প্রমোশন? শুধু গোপালগঞ্জ আর ফরিদপুর নিয়েই কি বাংলাদেশ? আমার এক ছাত্র, তার অনার্স ও মাস্টার্স দুটোতেই প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। শিক্ষক হিসেবে তার চাকরি হয়নি। কেননা সে দলবাজ ছিল না। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্টকে আমরা শিক্ষক হিসেবে নেইনি, নিয়েছি ফার্স্ব ক্লাস সপ্তমকে। এর পেছনে যে ‘কাহিনী’, সেই ‘কাহিনী’ এ জাতির জানা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ‘কালো বিড়াল’, সেই ‘কালো বিড়াল’ খুঁজে বের করা প্রয়োজন। একটি বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের জন্য এসব ‘কাহিনী’ কি যথেষ্ট নয়? ইতিহাসে শরীফ এনামুল কবিরের নাম থেকে যাবে বটে, কিন্তু সেই ‘নামকে’ উজ্জ্বল করবে না।
আমি যখন মঞ্জুরি কমিশনে ছিলাম, তখন তদন্ত করে দেখেছিলাম অনেক ভিসি অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ করেন। ব্যক্তিগত কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ব্যবহার করেন। আমি মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট জমা দিয়েছিলাম। এখন শুনছি জাবির সাবেক ভিসি একাধিক গাড়ি ব্যবহার করতেন। তার মেয়ে ঢাকায় পড়তে যেত সরকারি জ্বালানি খরচ করে। এটা যদি সত্য হয়ে থাকে, তা হলে তা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য। আরেকজন উপ-উপাচার্য গত চার বছর নিয়মিত ঢাকা থেকে গিয়ে সরকারি জ্বালানি (গ্যাস নয়, অকটেন) খরচ করে অফিস করেছেন। তিনি এটি পারেন না। মঞ্জুরি কমিশনের উচিত ‘সরকারি অর্থের অপচয়ের’ অভিযোগটি তদন্ত করে দেখা। একজন উপাচার্য, উপ-উপাচার্য আর্থিক কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হবেন না এমনটাই দেখতে চাই।
ভিসিরা কেন এমন হয়? ভিসি হলেই নিজ এলাকার লোকদের চাকরি দিতে হবে? রংপুরের কিংবা বরিশালের ভিসির কাহিনী ভয়াবহ। রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তার আপনজন থেকে শুরু করে তার গ্রামের বাড়ির প্রায় অর্ধশত লোককে ‘চাকরি’ দিয়েছেন। ছেলে, ছেলের বউ, ভাই-কে নেই লিস্টে। এরা কেমন উপাচার্য? জাবির ভিসি তার নিজের মেয়েকে শিক্ষক বানাননি বটে; কিন্তু তার সঙ্গে যারা ‘দল’ করেছেন তাদের সবার সন্তানদের, তাদের বউ অথবা স্বামীদের ‘চাকরি’ হয়েছে জাহাঙ্গীরনগরে। তারা এত ‘মেধাবী’ যে তাদের অন্য ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোথাও চাকরি হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় কি চাকরির একটি ক্ষেত্র? এখানে নিজের আত্মীয়স্বজন, কিংবা দলীয় লোকদের অথবা নিজ এলাকার লোকদের চাকরি দিতে হবে? এমন ভিসি আমরা কবে পাব, যিনি দলবাজ হবেন না, যোগ্য ছাত্রদেরই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেবেন! শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা তাই প্রয়োজন। শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে ‘সাফল্য’ বিবেচনায় নিলে চলবে না। তার উপস্থাপনের যোগ্যতা ও লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষা নেয়াও জরুরি। আর এ কাজটি করবে মঞ্জুরি কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় নয়। উপাচার্যের হাতে শিক্ষক নিয়োগের কোনো ক্ষমতা থাকবে না। আর এর চেয়েও বড় কথা একজন ছাত্রের পাস করার পর গবেষণা সহকারী হিসেবে একজন সিনিয়র শিক্ষকের অধীনে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। পৃথিবীর প্রতিটি উন্নত দেশে এমনটি আছে। তার পরই তাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে, এর আগে নয়। অধ্যাপক আজাদ চৌধুরী মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান। তিনি তো পারেন সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের জন্য নতুন একটি আইন করতে। এটি নিয়ন্ত্রণ করবে মঞ্জুরি কমিশন। উপাচার্যের হাতে ক্ষমতা থাকলে দলবাজ শিক্ষকদের সন্তানরা শিক্ষক হবে, আর মেধাবীরা হারিয়ে যাবে। জাবির শিক্ষকদের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে বিগত তিন বছরের সকল অনিয়মের শ্বেতপত্র প্রকাশ করার। ক্ষতি কী? বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থেই এটি করা উচিত। আর এভাবে অনির্বাচিত উপাচার্য নয়, আমরা চাই নির্বাচিত একজন উপাচার্য, যার দায়বদ্ধতা থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবারের কাছে। জাবিতে অনেক ‘ক্ষত’ সৃষ্টি হয়েছে। সাবেক ভিসি এই ‘ক্ষত’গুলো সারিয়ে তোলার কোনো উদ্যোগ নেননি। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক ঘটনা ঘটেছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে সিনিয়র শিক্ষকরা অপমানিত হয়েছেন। অত্যন্ত সুকৌশলে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব ‘তৈরি’ করা হয়েছে, যা কাঙ্ক্ষিত নয়।
ভিসিদের কাহিনী যেভাবে প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে, তাতে করে কোনো শুভবুদ্ধির মানুষ আগামীতে আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হবেন না। দেশে ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ৩৫ জন শিক্ষককে আমরা ভিসি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছি। আর যারা ভিসি হচ্ছেন, তাদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এই একুশ শতকে এসেও খোদ রাজধানীতে ভিসি হয়েছেন এমন অনেক শিক্ষক, যাদের অনার্স ডিগ্রি নেই, একজনের আবার পিএইচডি ডিগ্রিও ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক আনুগত্য ছিল প্রবল। তাই ভিসি হয়েছেন। সম্ভবত সময় এসেছে এটা বিবেচনায় নেওয়ার যে, একটা সার্চ কমিটির মাধ্যমে ভিসি নিয়োগ এখন সময়ের দাবি। দলীয় বিবেচনায় ভিসি নিয়োগ হলে তারা দলীয় লোকদেরই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেবেন। এটাই স্বাভাবিক। এতে করে আমরা উচ্চশিক্ষাকে ধ্বংস করে ফেলছি। আর আমরা পরিণত হচ্ছি মেধাশূন্য একটি জাতিতে।
লেখক : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
www.tsrahmanbd.blogspot.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন